নির্দ্বিধায় টেন্ডারবাজি সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল করুন
বিশেষ প্রতিনিধি : মাওরানা সাইফুদ্দিন মানিক
জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর ২৩ দফা নির্দেশনা
বিশেষ প্রতিনিধি২৫ জুলাই, ২০১৮ ইংপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘এখানে কে কোন দল করে, কে কী করে-সেগুলো দেখার কোনো দরকার নেই। যদি কেউ বাধা দেয়, আপনারা সরাসরি আমার সঙ্গে বা আমার অফিসে যোগাযোগ করতে পারবেন। সরকারপ্রধান হতে পারি, আমি কিন্তু জাতির পিতার কন্যা, আপনাদের সেটাও মনে রাখতে হবে। আমরা সমাজ থেকে এসব অশুভ তত্পরতা নির্মূল করে মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই।’ গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেলা প্রশাসকদের শিল্পাঞ্চলে শান্তিরক্ষা, বিনা দ্বিধায় আপনারা এই টেন্ডারবাজি, পেশিশক্তি, সন্ত্রাস ও মাদক নির্মূল করবেন। এছাড়া পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করতেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব আপনাদের, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের। আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের মধ্যে অনেক উদ্ভাবনী শক্তি আছে। আপনারা এই উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একটি দেশের উন্নয়নে দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকা এবং সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকা অত্যন্ত জরুরি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটানা দুই মেয়াদে প্রায় সাড়ে নয় বছর সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি। এর ফলে আমরা অনেক উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি। আর্থসামাজিক খাতে আজ বাংলাদেশের যে অভাবনীয় অগ্রগতি, তা সম্ভব হয়েছে এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকার জন্য।’
জেলা প্রশাসকদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ২৩ দফা নির্দেশনা
সরকারি সেবা পেতে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখাসহ অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকদের ২৩ দফা নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। নির্দেশনাগুলো হচ্ছে- (১) সরকারি সেবা পেতে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। (২) যুব সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। মাদকবিরোধী অভিযান চলবে। (৩) জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আরও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। (৪) গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে উদ্যোগী হতে হবে। (৫) তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। (৬) তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে। (৭) শিক্ষার সকল স্তরে নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। (৮) ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। (৯) কৃষি-উত্পাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুত্, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। (১০) ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। (১১) দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। (১২) পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। (১৩) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২’ এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনাবলি অনুসারে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (১৪) সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে। (১৫) জেলা প্রশাসকগণ জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সকল কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করতে হবে। (১৬) দপ্তরসমূহের বিদ্যমান সেবাসমূহ তৃণমূলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য মেলা, সেবা সপ্তাহ পালনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। (১৭) শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য-পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, পেশীশক্তি ও সন্ত্রাস নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (১৮) বাজার-ব্যবস্থার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির যেকোন অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। (১৯) নারী ও শিশু নির্যাতন ও পাচার, যৌতুক, ইভটিজিং এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। (২০) নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। (২১) নিজ নিজ জেলায় ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংস্কৃতিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে। (২২) প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (২৩) পার্বত্য জেলাসমূহের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে হবে।
শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশকে আমরা ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়তে চাই। এ জন্য সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী দিনে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, দিনাজপুর এবং বরিশালের মধ্যে বুলেট ট্রেন (দ্রুতগতির ট্রেন) চালুর পরিকল্পনা তার সরকারের রয়েছে। তিনি সিলেট বিমানবন্দরকে উন্নত ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আঞ্চলিক এয়ারপোর্ট হিসেবে উন্নীত করার কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রী রেল যোগাযোগের পরিসর আরও বাড়ানোর জন্য ঢাকা থেকে বরিশালসহ পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপন এবং ভবিষ্যতে বিমান ও হেলিকপ্টার নির্মাণের লক্ষ্যে লালমনিরহাটে একটি অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আকাশযান তৈরির কারখানা স্থাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে দেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাট জেলাকে। জেলার পরিত্যক্ত এয়ার স্ট্রিপে প্রথমে অ্যারোনটিক্যাল সেন্টার স্থাপন করে প্রাথমিকভাবে বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো মেরামত ও ওভারহোলিংয়ের কাজ করা হবে, পরে সেখানে এসব আকাশযান তৈরিও করা হবে। এ বিষয়ে তিনি বিমানবাহিনী প্রধানকে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপমুক্ত একটি সুখী, সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক, জ্ঞান-নির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ। এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক এবং মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পক্ষে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান, চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন আহমেদ, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক বেগম শায়লা ফারজানা ও রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার মো. নূর-উর-রহমান বক্তৃতা দেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সচিব, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, সব জেলার জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনাররা উপস্থিত ছিলেন। তিন দিনের এ সম্মেলন আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলবে।